প্রথমেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই শুরু করতে হয়-
ক্ষেতে ক্ষেতে পুইরা মরিরে ভাই,
পাছায় জোটে না ত্যানা
বৌ-য়ের পৈছা বৈকায় তবু,
ছেইলা পায়না দানা।
বহু বছর আগে কৃষকদের দুঃখ, দূর্দশার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত তার ‘‘চাষার দুঃখ” প্রবন্ধে এই উক্তিটি উল্লেখ করেছিলেন। দীর্ঘ বছর পরেও দেশের সব কিছু পরিবর্তন হয়ে উন্নত থেকে উন্নতর হলেও কৃষক আর নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তনই ঘটেনি!
এখনো কৃষকরা যেন ত্যানা ছাড়াই রয়ে গেছেন! অবশ্য ত্যানা না জোটারই কথা। কারণ দিনরাত প্ররিশ্রম করে একটু লাভের আশায় কৃষকরা যে ফসল ফলান। নির্ধারিত মূল্য না পেয়ে উল্টো যখন আরো লোকসান হয় তখন সে সোনালী ফসলগুলোই যেন তাদের বিষফোড়া হয়ে যায়!
দেশের সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটলেও কৃষকের দুরবস্থা যেন দীর্ঘকাল ধরেই স্থীর হয়ে আছে! প্রতি বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে বীজ, সার, সেচ, কাটা, মাড়াই দেয়া সহ মোট খরচ হয় প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু সে হিসেবে প্রতি বিঘা জমির ধানের বাজার মূল্য মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। যেখানে প্রতি বিঘা জমির ধানে লোকসান প্রায় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। এ লোকসান সমসাময়িক কোন সমস্যা নয়, প্রায় শত বছর পূর্ব থেকেই দেশের কৃষকেরা তাদের সঠিক ন্যায্য মূল্য পান না! এমত অবস্থায় কৃষকদের পাছায় ত্যানা জোটার কোন উপায়ই দেখছি না।
আর তাই দেশের কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। ১৯৯৫ সালের হিসেব অনুযায়ী যেখানে দেশের কৃষি কাজের হার ছিলো ৬৩% সেখানে ২০০৮ সালে কৃষি কাজের হার কমে ৪৭% এ চলে এসে।
শহরা লে শিল্প ও কল কারখানার উন্নতির ফলে কৃষকরা তাদের পেট বাঁচাতে কৃষি কাজ ফেলে শহরে গিয়ে শিল্প ও কল কারখানায় যোগ দিচ্ছেন। সেখানের অবস্থাও যে খুব ভালো আছে তা নয়। একদিকে যেমন কৃষকদের দুরাবস্থার কোন শেষ নেই অন্যদিকে পুজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনেরও যেন কোন মূল্য নেই।
মালিক শ্রেণীর লোকেরা নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের শ্রমকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ছে ঠিকই অথচ যাদের শ্রমে তারা কোটিপতি বনে যাচ্ছেন সেই নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের জীবনই যেন অনিশ্চয়তায় ভরা! শ্রম ব্যতিত দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং কর্মজীবী নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের কোন মূল্য নেই তা এই মহামারি করোনা ভাইরাস আরো একবার সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
করোনা আতঙ্কে বিশ্বের ৭৮০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটির বেশিই গৃহবন্দী (জুন মাসে)। যার প্রভাবে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক সহ নিম্ন আয়ের মানুষজন।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে প্রায় সাড়ে ছয় কোটির মত শ্রমিক রয়েছে। লকডাউনের কারণে গত এক মাস ধরে বেকার হয়ে চরম দুঃসময় পার করছেন এসব শ্রমিকরা। ঘাম ঝরা আর হাড় ভাঙা খাটুনি করে যাদের জীবন তাদের কান্না যেন শোনার কেউ নেই।
দেশে গত এক মাস ধরে পরিবহন বন্ধ থাকায় চালক হেল্পার সহ বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মচারী! দীর্ঘদিন আয় না থাকায় কঠিন হয়ে পরেছে তাদের জীবন যাপনও! পরিবহন মালিক রাও তাদের ব্যয় বহনের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। যাদের শ্রম দিয়ে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছেন অথচ বিপদকালে যেন উর্ধ্বে ধাবন!
অন্যদিকে করোনার ধাক্কা বড় করে লাগতে শুরু করেছে পোশাক খাতেও! বিশ্বব্যাপি বিক্রেতারা প্রতি বছর শুধুমাত্র পোশাক বিক্রি করে প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। কিন্ত এই সংকটাপূর্ণ অবস্থায় বিক্রেতারাও শ্রমিকদের পাশে নেই। সম্প্রতি বিবিসির দেওয়া তথ্য মতে, এভাবে চলতে থাকলে চাকরি হারানোর পথে প্রায় ২০ লক্ষ পোশাক শ্রমিক! সাড়া বছর মালিকরা যাদের শ্রম দিয়ে মুনাফা অর্জন করে নেন দুই এক মাস তাদের বেতন না দিতে পারা সত্যিই দুঃখজনক বৈকি!
অথচ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রধান ৫ টি (উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ এবং কৃষি) খাতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই পোশাক, পরিবহন এবং কৃষি খাত। গত অর্থ বছর তথা ২০১৮-২০১৯ সালের জিডিপিতে ৬৭ শতাংশ (সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা) অবদান রেখেছে এই খাত গুলো। এছাড়াও বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে।
যে সকল মানুষের শ্রমের উপর নির্ভর করে এ দেশ বাঁচে, এদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। যাদের অক্লান্ত প্ররিশ্রমের ফলে মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা আয় করে আরাম-আয়েশে দিন কাটান বিপদকালে তাদের পেট পূজা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকে না।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুব দ্রুতই ভেঙ্গে পরার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই কৃষি এবং শ্রমিক নির্ভর এই বাংলাদেশকে বাঁচাতে কৃষিজীবী এবং শ্রমজীবী মানুষদের জীবনমান নিশ্চিত করা অতিব জরুরী।
আবু সাঈদ চৌধুরী,
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
রিপোর্টার, দৈনিক যায়যায়দিন।
Comments
Post a Comment